
শুধু চিকিৎসায় ২,৫১২ টাকা, নির্যাতিত নারীদের ঘাড়ে ব্যয়ের বোঝা,
নারীর প্রতি সহিংসতা থামছে না, নীরবতায় ঢেকে যাচ্ছে হাজারো আর্তনাদ
স্টাফ রিপোর্টার
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে অনেক নারীর জীবন কাটছে সহিংসতা আর নির্যাতনের মধ্যে। কখনো স্বামী, কখনো প্রেমিক বা আত্মীয় পরিচিত মুখগুলোর হাতেই তাঁরা শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নির্যাতনের কোনো বিচার হয় না, কারণ ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে ভয় পান।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার এক তরুণী জানান, যৌতুকের জন্য তাঁর স্বামী প্রায়ই মারধর করতেন। একবার স্বামী এমন জোরে লাথি মারেন, যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। চিকিৎসায় খরচ হয় ৫-৬ হাজার টাকা। তিনি বলেন, “মানুষ কী বলবে এই ভয়েই কোনো মামলা করিনি।”
যশোরের আরেক নারী তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি জানান, দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে সংসার শুরু করলেও এখন স্বামী তাঁকে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করতে গিয়ে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা।
জরিপে ভয়ংকর চিত্র
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) যৌথভাবে প্রকাশ করেছে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’। এতে উঠে এসেছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার হলেও স্বামী বা জীবনসঙ্গীর হাতে শারীরিক, মানসিক, যৌন বা আর্থিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গত ১২ মাসেই ৪১ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই সংখ্যা শহর ও গ্রামে ভিন্ন হলেও সামগ্রিক চিত্র ভয়াবহ।
জরিপে দেখা যায়, নির্যাতনের পর যারা চিকিৎসা নিয়েছেন, তাঁদের গড়ে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৫১২ টাকা এবং আইনি সহায়তায় ব্যয় হয়েছে গড়ে ৪ হাজার ১০৪ টাকা।
নীরবতা যেন নতুন স্বাভাবিকতা
ঢাকার এক তরুণী জানান, প্রেমিক বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, পরে অন্যত্র বিয়ে করে। প্রতিবাদ করতে গেলে প্রেমিক ও তাঁর পরিবারের হাতে মার খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হয়।
এই ধরনের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। জরিপ বলছে, **নির্যাতনের শিকার নারীদের ৬৪ শতাংশ কেউকে কিছুই বলেন না**। তাঁদের মধ্যে ৫১ শতাংশ জানেন না কোথায় অভিযোগ করতে হবে। মাত্র ৭ শতাংশ নারী সাহস করে আইনি পদক্ষেপ নেন।
বিচার ব্যবস্থায় ভরসার সংকট
নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় বিচার পাওয়ার হার অত্যন্ত কম। ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে দায়ের হওয়া ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার মধ্যে **৯৭ শতাংশেই আসামিরা খালাস পেয়েছেন বা বিচার শুরু হওয়ার আগেই মুক্তি পেয়েছেন**।
সমাধান কোথায়?
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান মনে করেন, “এত বছর ধরে যে ধরনের সহিংসতা চলছে, তা রোধ করতে সামাজিক প্রতিরোধ দরকার। নির্যাতনের শিকার নারীদের কথা গুরুত্বসহকারে শুনতে হবে, এবং দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ভুক্তভোগীদের জন্য সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য আইনি ও চিকিৎসা সহায়তা গড়ে তুলতে হবে। না হলে তাঁরা কখনোই সাহস করে সামনে আসতে পারবেন না।