আন্তর্জাতিক

ইসরায়েলে কেন অনেক ভারতীয়, কী করেন তারা, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কীভাবে চলছে জীবনযুদ্ধ

ইরান ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে রীতিমতো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন দেশটিতে বসবাসরত হাজার হাজার ভারতীয় প্রবাসী। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা ও নির্মাণ খাতে কর্মরত বহু শ্রমিক এখন নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের মধ্যে পড়েছেন। এদের অনেকেই দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে গিয়ে বছর পর বছর ধরে ইসরায়েলে কাজ করছেন। তবে বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি তাঁদের জীবনকে অস্থির করে তুলেছে।

তেল আভিভে কেয়ারগিভার হিসেবে কাজ করছেন কর্ণাটকের বাসিন্দা রাঘবেন্দ্র নাইক। তিনি বলেন, “ছয় বছর বয়সী মেয়েটাকে বহুদিন ধরে দেখি না। ভেবেছিলাম সামনের মাসে দেশে যাব, কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এখন জানি না কবে যেতে পারব।”

নাইক জানান, প্রতিটি রাতে তাঁরা আতঙ্কে ঘুমান। যেকোনো সময় সাইরেন বেজে ওঠে, তখনই তাঁকে আশ্রয় নিতে হয় ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে। “এমনও রাত গেছে, এক মুহূর্তের জন্যও চোখ লাগেনি। মনে হয়, ফিরতে পারব তো?  এমন উদ্বেগ নিয়েই দিন কাটছে তাঁর।

ঘরে ফেরা অনিশ্চিত, প্রিয়জনদের দেখা অসম্ভব

দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলে বসবাস করছেন এমন আরও অনেক ভারতীয় এই মুহূর্তে পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হারিয়ে ফেলেছেন। ইসরায়েল তেলেঙ্গানা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সোমা রভি জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে ফিরেছেন। “বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় সব পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে।

প্রায় দুই দশক ধরে ইসরায়েলে আছেন রভি, তিনি বলেন, এমন অনিশ্চয়তা আগে কখনো অনুভব করিনি।

ভারতীয় সরকার উদ্যোগ নিয়েছে নাগরিকদের ফেরাতে

বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ভারত সরকার তার নাগরিকদের ফেরাতে তৎপর হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলে আটকে পড়া ভারতীয়দের প্রথমে স্থলপথে নিরাপদ অঞ্চলে আনা হবে, সেখান থেকে বিশেষ বিমানে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

তেল আভিভে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস ইতিমধ্যে জরুরি সাপোর্ট সেল চালু করেছে, যারা ফেরত যেতে চান, তাদের নিবন্ধনের আহ্বান জানানো হয়েছে।

কেন এত ভারতীয় ইসরায়েলে’

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার ভারতীয় ইসরায়েলে কর্মরত রয়েছেন। যদিও বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। মূলত কেয়ারগিভার, নার্স, নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তারা।

ইসরায়েলে প্রবীণদের বড় একটি অংশ ভারতীয় কেয়ারগিভারদের উপর নির্ভরশীল। এই খাতে প্রশিক্ষিত জনবল আসছে মূলত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো থেকে। এছাড়া, ইসরায়েলের নির্মাণ খাতে ভারতীয় কর্মীদের চাহিদাও বেড়েছে। গাজা-সংঘাতের কারণে ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের অনুপস্থিতিতে, ভারতের দিকে নজর দিচ্ছে ইসরায়েলি নির্মাণ কোম্পানিগুলো।

‘আমরা যা আয় করি, তাতেই পরিবার চলে’ ফিরে যাব কোথায়

পিএন লরেন্স নামে এক প্রবাসী বলেন, “ইসরায়েল যুদ্ধবিধ্বস্ত হলেও কাজের দিক থেকে স্থিতিশীল। সরকার স্বাস্থ্যবিমা, নিরাপত্তা, এবং বেতন নিশ্চিত করে। আমি যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলাম কিছুদিন, কিন্তু আবার ফিরে এসেছি। এখানে যা আয় করি, তাতে দেশে থাকা পরিবারটা বাঁচে। এমন আয় অন্য কোথাও পাই না।

আতঙ্কের মধ্যেও বন্ধন অটুট

ইসরায়েলে বসবাসরত ভারতীয়রা শুধু পেশাগতভাবে নয়, সামাজিকভাবেও একে অপরের সঙ্গে জড়িত। তেল আভিভের কাছাকাছি এলাকায় তারা ভাড়া বাড়িতে একসঙ্গে থাকেন, ছুটির দিনে মিলিত হন, উৎসব উদযাপন করেন। ব্যবসায়ী বেনি নাইডু বলেন, “আমরা একে অপরের খোঁজ রাখি। তবে গাজার পরে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি আমাদের সবার জীবন পাল্টে দিয়েছে।”

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদিদের অভিজ্ঞতা

ইসরায়েলে বসবাসকারী প্রায় ৮৫ হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদি রয়েছেন, যারা মূলত মহারাষ্ট্র, কেরালা, কলকাতা, এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিজোরাম ও মণিপুর থেকে ইসরায়েলে গেছেন। তাদের অনেকেই এখন আতঙ্কে। জেরুজালেমে বসবাসকারী আইস্যাক ওয়াস্কার বলেন, “আগে গাজার সঙ্গে লড়াই ছিল, এখন ইরান। আমাদের চতুর্দিকে যেন মৃত্যুর ফাঁদ।

‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দেশে ফিরব’

শেষ পর্যন্ত অনেকেই এখন দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন। নাইক বলেন, “আগে বছরে একবার দেশে যেতাম। এখন যুদ্ধের ভয়ে তা পারছি না। ভেবেছিলাম এখানেই থিতু হব, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ফিরে যাই।”

এই যুদ্ধ পরিস্থিতি কেবল রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, মানবিক দিক থেকেও হাজার হাজার শ্রমজীবী প্রবাসীর জীবন ও স্বপ্নকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

 যারা এখনো ইসরায়েলে অবস্থান করছেন, তাদের স্থানীয় দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button