আন্তর্জাতিকবিশ্ব

বাবা-মাকে বাড়ি ছাড়ার জন্য রাজি করাতে পারিনি’  বিবিসি সাংবাদিকের হৃদয়স্পর্শী বিবরণ

বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী, মাঝে মাঝে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের শব্দ। কিন্তু ঘরের ভেতরে একজন বৃদ্ধা বিছানায় শুয়ে ছেলেকে বলছেন, “আমার এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবার মতো শরীর নেই।”

এটাই আজকের তেহরান ইরানের রাজধানী, যেখানে যুদ্ধের হুমকি, মানবিক সংকট ও রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতার ভেতরেও বহু মানুষ জড়িয়ে আছেন নিজেদের বাড়ি, জীবন ও স্মৃতির সঙ্গে।

যেখানে মৃত্যু নয়, সম্মানের সঙ্গে থাকা মুখ্য বিষয়

সম্প্রতি মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিবৃতিতে তেহরানের বাসিন্দাদের ‘অবিলম্বে শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে’ চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সবাই কি যেতে পারে?

তেহরানের বহু পরিবার যুদ্ধের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই রয়ে যাচ্ছেন শহরে। অনেকের বয়স হয়েছে, অনেকে শারীরিকভাবে এতটাই দুর্বল যে যানজটপূর্ণ পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রা করা তাঁদের জন্য একপ্রকার অসম্ভব।

তেহরানের এক বাসিন্দা বলেন, “আমার মা ভার্টিগো রোগে ভুগছেন, বাবার হাঁটতে কষ্ট হয়। আমি কীভাবে তাঁদের নিয়ে সেই ভিড় ঠেলে অন্য শহরে যাব?”

এমন অসংখ্য গল্প শহরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে রয়েছে। এক নারী জানান, তার বাবা-মা মনে করেন, “যেখানে জন্ম, সেখানেই মৃত্যু হোক। এটা হার মানার বিষয় নয়, বরং নিজেদের সম্মানের সঙ্গেই শেষটা মেনে নেওয়া।”

নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা ভেঙে পড়েছে, শহর যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে

রাজধানী শহর হয়েও তেহরানে এখন জ্বালানি, খাদ্য ও পানি তিনটি মৌলিক চাহিদারই চরম ঘাটতি। নগরজুড়ে বেশিরভাগ এটিএম মেশিন ফাঁকা। দোকানপাট বন্ধ, পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে বহু এলাকায়।

এক বাসিন্দা বলেন, “যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহেই আমাদের এলাকায় পানির পাইপ ফেটে যায়। আজও তা ঠিক হয়নি। খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।”

পাশাপাশি বেড়েছে জ্বালানির সংকট। সরকার গাড়িচালকদের প্রতিদিন মাত্র ২৫ লিটার তেল বরাদ্দ দিয়েছে। ফলে অনেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় আটকে পড়ছেন, মাঝপথে তেল ফুরিয়ে যাচ্ছে।

রাস্তার জীবনের দায়িত্ব নিয়েছে মানুষ, বেড়ালদের জন্য শহর ছাড়ছেন না অনেকে

তেহরানের আরও একটি আশ্চর্য দৃশ্য এখন মানুষের চোখে পড়ছে রাস্তার বেড়ালগুলোর দেখভাল করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

“আমার সন্তানদের নিরাপদে পাঠিয়েছি, কিন্তু আমি শহর ছাড়িনি। এই বাড়ির নিরাপত্তা, এই রাস্তার বেড়ালগুলো এদের ছেড়ে যেতে পারিনি,” বলছিলেন এক বৃদ্ধ।

শহরে এখনো চালু রয়েছে একটি বিশেষ ‘ক্যাট মিউজিয়াম’ নাম ‘মিয়াওজিয়াম’। অনেকে বিশ্বাস করেন, তেহরান শুধু মানুষ নয়, প্রাণীদেরও শহর এদের ফেলে যাওয়া যায় না।

রাস্তায় দুঃস্বপ্নের মতো যানজট, গন্তব্যে পৌঁছানো মানেই এক নতুন যুদ্ধ

যারা শহর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের জন্যও পথ মোটেই সহজ নয়। উত্তরাঞ্চলের প্রদেশ মাজান্দারান ও গিলানে পৌঁছাতে যেখানে সাধারণত তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে, এখন সেই যাত্রায় সময় লাগছে ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি।

একজন বলেন, “চালকরা গাড়ির এসি চালাতে পারছেন না, তেলের সাশ্রয় করতে হচ্ছে। গরমে গাড়িতে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আর রাস্তার পাশে পেট্রোলপাম্পে লাইনের শেষ কোথায় কেউ জানে না।”

যারা পৌঁছেছেন, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বাসস্থান ও খাদ্যের নতুন সংকট

গন্তব্যে পৌঁছেই শুরু হচ্ছে নতুন সমস্যা। থাকার জায়গা নেই, বাড়িভাড়া চড়া, হোটেলগুলিতে জায়গা নেই। পণ্যবাহী ট্রাক না থাকায় খাবারের দাম আকাশছোঁয়া।

এক ব্যক্তি বলেন, “যে টাকায় আগে এক সপ্তাহ চলতাম, এখন এক দিনের বাজার করতেই সব চলে যাচ্ছে।”

এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা, যার মাঝে পড়ে গেছেন নিরপরাধ নাগরিকরা

তেহরানের বাসিন্দারা বিশ্বাস করেন, তারা এক অসম লড়াইয়ে আটকে গেছেন একদিকে দেশের ভেতরের শাসনের অমানবিকতা, অন্যদিকে বাইরের আগ্রাসন।

এক নারী বলেন, “আমরা যেন দুই দানবের মাঝখানে পড়ে গেছি ইসরায়েল ও তাদের মিত্ররা একদিকে, নিজের সরকার আরেকদিকে। কেউ আমাদের নিয়ে ভাবে না।”

তিনি বলেন, “যখন একজন বিদেশি নেতা বলেন তেহরান ছেড়ে যাও, তখন তিনি হয়তো বুঝতেই পারেন না এটা শুধু শহর নয়, আমাদের অস্তিত্ব।”

তেহরান এখন কেবল এক শহর নয়, এক প্রতিরোধের প্রতীক

মানুষ শহর ছাড়ছে, অনেকে পারছে না। কেউ স্বেচ্ছায় থেকে যাচ্ছে, কেউ বাধ্য হয়ে। কিন্তু সবাই লড়ছে সম্মানের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, অথবা নিজের মাটি ও স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকার জন্য।

তেহরান এখন কেবল যুদ্ধের ছায়ায় ঢাকা একটি শহর নয়, এটি হয়ে উঠেছে মানুষের মনের প্রতিচ্ছবি যেখানে ‘বাস্তবতা’ অনেক সময় সব রাজনৈতিক বক্তব্যকে হার মানিয়ে দেয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button