
বরগুনায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ: স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চাপে স্থানীয় প্রশাসন
সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ, নতুন সেরোটাইপ নিয়ে গবেষকদের শঙ্কা
বরগুনা প্রতিনিধি ●
বরগুনা জেলায় চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি এক ভয়াবহ মোড় নিয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, আর তাতে জেলার স্বাস্থ্যখাত পড়ে যাচ্ছে বাড়তি চাপে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, এটি শুধুমাত্র একটি মৌসুমি রোগের বিস্তার নয় বরং এটি দেশের প্রস্তুতির ঘাটতির একটি সতর্ক সংকেত।
সোমবার সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২৪৩ জন। এর মধ্যে বরগুনা জেলা একাই দিয়েছে ৬৫ জন রোগী যা দেশের একক কোনো জেলার তুলনায় উল্লেখযোগ্য। বরিশাল বিভাগের মধ্যে বরগুনায় আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
কেন এত ভয়াবহ পরিস্থিতি বরগুনায়?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমেদ বিষয়টিকে কেবল সংখ্যার খেলা হিসেবে দেখছেন না। তাঁর মতে, “বরগুনার পরিস্থিতি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে যেসব কৌশল ব্যবহার করছি, তা যথেষ্ট নয়। ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যেসব জায়গায় স্বাস্থ্যসেবা ও স্থানীয় সরকার কাঠামো দুর্বল, সেসব জায়গা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে।”
বরগুনা সদর হাসপাতালে ২৫০ শয্যার বিপরীতে বর্তমানে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০০। পরিস্থিতি সামাল দিতে আলাদা ৫০টি শয্যা বরাদ্দ করা হলেও সেগুলোতেও রোগী উপচে পড়ছে। এর মধ্যে দেখা দিয়েছে চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় স্যালাইনের সংকটও। সিভিল সার্জন মো. আবু ফাত্তাহ জানিয়েছেন, স্থানীয় কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে এসে স্যালাইনের ঘাটতি কিছুটা পূরণ করছে।
নতুন সেরোটাইপ, নতুন শঙ্কা?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। গত বছর পর্যন্ত ২ নম্বর সেরোটাইপ বেশি দেখা গেলেও, এ বছর নতুন কোনো সেরোটাইপ সক্রিয় হয়েছে কি না, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থা আইসিডিডিআরবি-র বিজ্ঞানী ড. শফিউল আলম মনে করেন, নতুন সেরোটাইপ থাকলে রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর হার উভয়ই বাড়তে পারে।
আইইডিসিআর-এর একদল গবেষক সম্প্রতি বরগুনায় গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন। তবে সংস্থাটির পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, “আমরা মূলত ঢাকার হাসপাতালগুলোর নমুনার উপর ভিত্তি করে কাজ করি। বরগুনার মতো এলাকার তথ্য আমাদের কাছে তেমনভাবে পৌঁছায় না, তাই সেরোটাইপ নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।”
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনা
ডেঙ্গু মশার উৎস নষ্ট পানি ও অপরিষ্কার কনটেইনার। কিন্তু বরগুনা শহরের বিভিন্ন এলাকায়, এমনকি হাসপাতালের পাশেও দেখা গেছে ডাবের খোসা, ফুলের টব বা ভাঙা বালতির মতো পানি জমার জায়গা পড়ে আছে। পৌরসভা ও স্থানীয় সরকারি দপ্তরগুলো বর্তমানে জনপ্রতিনিধিশূন্য, ফলে দায়িত্বশীলতা ও সমন্বয়ের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
সামনে কি আরও বড় সংকট?
ডা. বে-নজীর আহমেদ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “ডেঙ্গুর বিস্তার এখন ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি এখনও ঢাকাকেন্দ্রিক। এর ফলে ভবিষ্যতে আমরা আরও বড় বিপদের মুখে পড়তে পারি।”
সাধারণ মানুষের জন্য পরামর্শ
স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে নিজ নিজ বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা পানি অপসারণ করা এবং কোনো উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। একইসঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
শেষ কথা:
বরগুনার বর্তমান পরিস্থিতি সারা দেশের জন্য এক সতর্কবার্তা। এখনই যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।