
বান্দরবানের পাহাড়ে বাড়ছে প্রাণহানির ঘটনা, ৯ বছরে মৃত্যু ২৬ পর্যটকের
বান্দরবান প্রতিনিধি:
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বান্দরবান যেন এক দিক থেকে বিষাদও বয়ে আনছে। গত ৯ বছরে জেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন পর্যটক। সর্বশেষ গত সপ্তাহে তিন তরুণ-তরুণী পাহাড়ি ঢলে ভেসে প্রাণ হারিয়েছেন। এই মৃত্যুর ঘটনায় ফের প্রশ্ন উঠেছে বান্দরবানে পর্যটকদের নিরাপত্তা কোথায় দাঁড়িয়ে?
তথ্য বলছে, এ মৃত্যুগুলোর অধিকাংশই ঘটেছে বর্ষা মৌসুমে জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। বিশেষ করে পাহাড়ি ঝরনা, নদী ও খালে গোসল করতে গিয়ে কিংবা হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে বিপদে পড়েছেন পর্যটকেরা। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনায়ও ঘটেছে প্রাণহানি।
স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বলছে, পাহাড়ি এলাকা সম্পর্কে অজ্ঞতা, আবহাওয়া সম্পর্কে অসচেতনতা, এবং গাইডবিহীন ভ্রমণই এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। অনেকেই সতর্কতা না মেনে দুর্গম পাহাড়ে প্রবেশ করেন। কেউ কেউ আবার স্থানীয় নির্দেশনা অমান্য করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নেমে পড়েন, যেখানে হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে যায়।
রুমা, থানচি ও আলীকদম এই তিনটি উপজেলা দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত। রুমা উপজেলায় গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে পাইন্দু ইউনিয়নের তিনের সাইথার ঝরনা ও রিজুক ঝরনায় একাধিক প্রাণহানির রেকর্ড রয়েছে।
২০১৯ সালের আগস্টে থানচির দুর্গম এলাকায় একদল পর্যটক সপ্তাহব্যাপী আটকা পড়েছিলেন টানা বৃষ্টিতে। স্থানীয়দের সহায়তায় তাঁরা উদ্ধার হন। এসব ঘটনা বারবারই প্রশাসন ও পর্যটন কর্তৃপক্ষের নজরে আসছে, কিন্তু প্রতিকার এখনো স্পষ্ট নয়।
স্থানীয় ট্যুর অপারেটরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে নিয়ম না মেনে পর্যটক নিয়ে যাওয়ার। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় অনেকে নিবন্ধিত গাইড ছাড়াই পর্যটক দল পরিচালনা করেন, ফলে বিপদে পড়লে কেউ সাহায্য করতে পারে না। সর্বশেষ দুর্ঘটনায় এক ট্যুর কোম্পানির প্রধানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
অন্যদিকে কিছু আলোকপাতযোগ্য তথ্য:
* গত ৯ বছরে বর্ষায় পাহাড়ি ঢলে প্রাণ গেছে ১৩ জনের।
* শুকনো মৌসুমেও বগালেক ও খালে গোসলে নেমে ডুবে মারা গেছেন ১০ জন।
* সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩ জন।
* যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের বড় অংশই কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী।
বান্দরবান জেলা পুলিশ জানায়, অপরাধের দিক থেকে বান্দরবান এখনো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। অপহরণ বা বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা বিরল। তবে কিছু ছিনতাই ও আবাসিক হোটেলে ব্যক্তিগত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে একটি ঘটনায় এক তরুণীর মৃত্যু হয়।
আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “প্রতিটি পর্যটক নিবন্ধন ও অনুমতির মধ্য দিয়ে যেন ভ্রমণ করেন, সেটি নিশ্চিত করতে আমরা নিয়ম চালু করেছি। প্রতি দশজনের দলে একজন নিবন্ধিত গাইড বাধ্যতামূলক। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান লোভের বশে নিয়ম ভাঙছে, আর সেখানেই ঘটছে সমস্যা।”
বিশেষজ্ঞদের বার্তা পরিষ্কার:
শুষ্ক মৌসুমে পাহাড় তুলনামূলক নিরাপদ হলেও বর্ষায় প্রতিটি পদক্ষেপে থাকতে হয় সজাগ। ঝিরি–ঝরনা ও খালে হঠাৎ পানি বাড়তে পারে। অদৃশ্য স্রোতের কারণে সাঁতার জানলেও বিপদ এড়ানো কঠিন। পানিতে নামার আগে স্থানীয়দের মতামত নিতে হবে, আবহাওয়া খেয়াল রাখতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় না যাওয়াই শ্রেয়।
প্রকৃতি কখনো সুন্দর, কখনো ভয়ঙ্কর। বান্দরবানের অপার সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে যেন তা কাউকে কাঁদিয়ে না ফেরায় এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা ও নিয়ম মানার মানসিকতা।